ঢাকা , শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫ , ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
সরকার সংস্কার কমিশন করলেও নদীর ক্ষেত্রে প্রতিফলন নেই-আনু মুহাম্মদ বাড্ডায় কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষে নিহত ১ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বিপুল খরচেও কমানো যাচ্ছে না নানামুখী আতঙ্ক রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা সেই শিশু আছিয়া না ফেরার দেশে ধর্ষণে আতঙ্ক -উদ্বেগ ভারতকে অযাচিত বিভ্রান্তিকর মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে বলল ঢাকা প্রধান উপদেষ্টা চীন সফরে যাচ্ছেন ২৬ মার্চ সালমান এফ রহমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা খরায় পুড়ছে চা-বাগান উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা ইফতারিতে দই-চিড়ার জাদু একরাতে দু’জনকে কুপিয়ে হত্যা এলাকায় আতঙ্ক স্বাভাবিক নিত্যপণ্যের বাজার, সংকট সয়াবিনে মামলা থেকে স্বামীর নাম বাদ দেয়ার কথা বলে স্ত্রীকে ধর্ষণ ছেঁউড়িয়ায় শুরু লালন স্মরণোৎসব দোহাজারীতে বাসচাপায় ৩ জন নিহত হেনস্তার পর ছাত্রীকে ফেলে দিলো দুর্বৃত্তরা ৫৬০ মডেল মসজিদ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ভ্যাট দেয় না বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরনের কাপড় টিভি ফ্রিজ খাট টাকা সব পুড়ে শেষ বস্তিতে আগুন

বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন ব্যাহত

  • আপলোড সময় : ১৯-০২-২০২৫ ০২:৩৩:১৯ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১৯-০২-২০২৫ ০২:৩৩:১৯ অপরাহ্ন
বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন ব্যাহত
রংপুর প্রতিনিধি নদীত পানি নাই, চাইরো পাকে শুকি গেইছে। যখন পানি নাগে তখন তো ভারত পানি দেয় না। পানির অভাবোক ঠিক মতন হামার আবাদ হয় না বাহে। আগের মতো এ্যলা আবাদ না হওয়াতে বছরে বছরে খালি লোকসান বাড়ে। যখন যে সরকার গোদিত বসছে হামাক খালি তিস্তা নিয়্যা স্বপ্ন দ্যাকাইচে। কায়ো তো কামের কাম কিছুই করে নাই। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থাকার আক্ষেপ থেকে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব বয়সী কৃষক আবেদ ব্যাপারী। তিনি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার ধুসমারার চরের বাসিন্দা। আবেদ ব্যাপারীর মতো তিস্তাপাড়ের লাখো মানুষের অভিযোগ একই। তাদের কেউ বন্যায় নয়তো খরায় ক্ষতির হিসেব কষতে কষতে হয়েছেন সর্বস্বান্ত। কেউ বা কাঁদতে কাঁদতে হয়েছেন দিশেহারা। তবুও তারা আশায় বুক বেঁধেছেন। তিস্তা যদি প্রাণ ফিরে পায়, তাতে ঘুঁচবে তাদের দীর্ঘদিনের আক্ষেপ। এক সময়ের প্রমত্তা তিস্তা নদী এখন কঙ্কাল সার চেহারায়। শুষ্ক মৌসুমের আগেই পানিশূন্য তিস্তার পেটে জেগে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য চর। অথচ এক সময় এই তিস্তাকে বলা হতো উত্তরের জীবনরেখা, যা এখন দুই কোটি মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর সময়-অসময়ের বন্যায় পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে তিস্তা নদীর। উজানের পলিতে ভরাট হয়েছে নদীর বুক। ফলে বর্ষায় ভারতে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিতে তিস্তায় বন্যা দেখা দিচ্ছে। ফসল, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হচ্ছে। অনেক স্থানে হেঁটে নদী পারাপার হন স্থানীয়রা। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, প্রতিবছর দুই কোটি টনের বেশি পলি আনছে তিস্তা। শুষ্ক মৌসুমে যেখানে তিস্তার পানির প্রবাহ ৫ হাজার কিউসেক থাকার কথা, সেখানে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে তা নেমে এসেছে মাত্র ৪০০ কিউসেকে। ফলে পানির অভাবে প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তিস্তা অববাহিকায় শুধু কৃষিই নয়, নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বিলীন হয়েছে মাছের অভয়াশ্রম, বন্ধ হয়ে গেছে নদী-নির্ভর যোগাযোগব্যবস্থা। এতে জেলে, মাঝিসহ লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা এখন চরম সংকটে পড়েছে। বর্ষাকালে পানির স্রোত থামানো যায় না যে তিস্তায় সেটাতে শুষ্ক মৌসুমে বালু ছাড়া কিছুই থাকে না। এখন পানি না থাকায় গভীর নলকূপ বসিয়ে সেচ দিতে হচ্ছে কৃষকদের। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, তিস্তা নদীর অববাহিকায় বিভিন্ন চরাঞ্চলে প্রতিবছর ভুট্টা, মরিচ, কুমড়া, বাদাম, গম, তিসি, সূর্যমুখী ও পাট চাষ হয়। কিন্তু এসব ফসল ফলাতে কৃষকদের কষ্টের যেন শেষ নেই। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি না থাকা, আর বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষকদের। গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের মহিপুর এলাকার বাসিন্দা ধীরেন্দ্র নাথ বলেন, আগোত নদী ম্যালা গভীর ছিল। বড় বড় নৌকা যাতায়াত করছিল। এ্যালা তো তেমন গভীরতা নাই। শুকানের দিনোত মানুষ হাঁটি নদী পার হয়। নদী পার হয়া ঘোড়া গাড়িত করি হামরা ফসল নিয়া যাই। স্থানীয় জেলে রবিউল ইসলাম বলেন, নদীত পানি না থাকলে মাছ পাওয়া যায় না। ভারত তো হামাক চাইরো পাক দিয়্যা মারছে বাহে। পানির অভাবে চাষাবাদ করিয়্যাও শান্তি নাই। আগোত আবাদ সুবাদ করছি, মাছও ধরছি। এ্যালা কোনোটায় ঠিক মতো করা হয় না। ছালাপাক গ্রামের কৃষক সবুজ মিয়া বলেন, শুকনো মৌসুমে আমাদের এলাকায় পানির খুবই সংকট থাকে। এ সময় সেচ দিতে অনেক খরচ হয়। বিভিন্ন রকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। আবার যখন বর্ষা হয় তখন ভারত পানি ছাড়ে। এতে আমাদের এলাকা প্লাবিত হয়। বর্তমান ইউনূস সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া ভারত থেকে যেন পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করে। চর ইছলিতে কথা হয় কৃষক মফিজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, হামরা নদীপাড়ের মানুষ। সুখ-দুক্কের হিসাব করার সময় নাই। খরা, বান-সাঁতাওয়ের সাতে হামার বসবাস। বছরে বছরে ভারতে থাকি আইস্যা বালু পড়ি পড়ি নদীর তলপেট ভরাট হইছে। সরকার তো নদী বান্দি দেবার কতা কয়া ভোট নিয়্যা পালে গেল। হামার তিস্তা মহাপরিকল্পনার কোনো কাম করিল না বাহে। নদীর ভাটিতে যখন পানির অভাবে ভয়াবহ মরুকরণের মুখে তিস্তা অববাহিকা, তখন উজানে চলছে বিপরীত চিত্র। আন্তর্জাতিক নদী আইন অমান্য করে তিস্তার উজানে ভারত একাধিক বাঁধ, খাল, জলবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প নির্মাণ করেছে। ফলে তারা ইচ্ছামতো তিস্তার পানি ব্যবহার করছে, আর বাংলাদেশকে রেখেছে পানির সংকটে। এছাড়া এই অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতিও এখন ধ্বংসের সম্মুখীন। ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা অববাহিকার ১১৫ কিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশে। তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী হওয়া সত্ত্বেও ভারত একতরফা বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং প্রায় ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর বাংলাদেশের জন্য পানি ছাড়ে। যে পানি আশীর্বাদ না হয়ে বেশির ভাগ সময়ে এ দেশের মানুষের জন্য বয়ে আনছে অভিশাপ। ফলে অসময়ে তিস্তাপাড়ে বন্যা দেখা দিচ্ছে, বছর বছর বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। এমন পরিস্থিতিতে নদী গবেষক ও উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, উত্তরের পাঁচ জেলার দুই কোটি মানুষের জীবনমান রক্ষায় একমাত্র সমাধান হচ্ছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন। নদীকেন্দ্রিক কৃষিজমি রক্ষা, ভাঙন রোধসহ চরগুলো রক্ষায় সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো উজানের পলিতে নদীর বুক ভরাট হলে স্বল্প পানিতে প্রতিবছর অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। তারা মনে করছেন, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি তিস্তা নদীর সুরক্ষার বিষয়টিও এখন জরুরি। আইনজীবী ও সংগঠক পলাশ কান্তি নাগ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রংপুরকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তাই সরকারের বিশেষ গুরুত্বের অংশ হিসেবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হোক। তিস্তা ব্যারাজ তৈরি করে উত্তরাঞ্চলে খরার সময় মঙ্গা দূর করা হয়েছে, তেমনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রাণ-প্রকৃতিকে ঠিক রেখে বাস্তবায়ন করা হলে এখানকার জনগোষ্ঠী আত্মনির্ভরশীল হবে এবং দেশের উন্নয়নকে চলমান রাখা সম্ভব হবে। নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, তিস্তাকে যদি আমরা অভিশাপের হাত থেকে আশীর্বাদে পরিণত করতে চাই, তাহলে এ নদীর সুরক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা নদী। এটি নিয়ে এখন পর্যন্ত যৌথ কোনো সমীক্ষা হয়নি। তিস্তা ১০ হাজার কিউসেক পানি ধারণ করতে পারে। কিন্তু সেখানে ওই পরিমাণে পানি শুষ্ক মৌসুমে আসে না। তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর উজানের ঘোলা পানির সঙ্গে আসা পলি, পাথরসহ ময়লা-আবর্জনায় তিস্তার বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশনে স্বাক্ষর করে তিস্তার মতো যৌথ নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা। তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, তিস্তাপাড়ে প্রতিবছর ব্যাপক ফসলহানি ঘটছে। হুমকিতে পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা। নদীভাঙনে বাড়ছে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা, বাড়ছে রংপুর বিভাগে গড় দারিদ্র্যের হার। অথচ তিস্তাকে ঘিরে এ অঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা চলে। তিস্তা যদি আরও মরে যায় তাহলে কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। তিস্তায় সারাবছর পানির প্রবাহ ঠিক রাখা, ভাঙন, বন্যা, খরায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকসহ অসহায় মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি। এদিকে তিস্তাকে সুরক্ষা করা না গেলে শুধু জীবন জীবিকাই নয় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে নদী বিস্তৃত ২ হাজার বর্গকিলোমিটার জনপদের মানুষ। এ কারণে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে টানা ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচি পালন করছে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন।

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স
প্রতিবেদকের তথ্য